মোঃ কবিরুল ইসলাম কবির
প্রকাশ : Oct 31, 2025 ইং
অনলাইন সংস্করণ

ঐকমত্যের আড়ালে অগণতান্ত্রিক চাপ: একটি সুপরিকল্পিত ফাঁদ

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় একটি বয়ান ক্রমশ জোরদার করা হচ্ছে—বিএনপি নাকি সংস্কার চায় না। কিন্তু ২০২৪–২৫ সময়কালের ঘটনাপঞ্জি বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন বাস্তবতা সামনে আসে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার (Institutional Reform), নির্বাচনী বিচার (Electoral Justice) এবং সাংবিধানিক জবাবদিহিতা (Constitutional Accountability) বিষয়গুলোতে বিএনপিই প্রথম দিন থেকে কাঠামোগত প্রস্তাব রেখেছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ গত আগস্টে মন্তব্য করেন—
“গণতান্ত্রিক বিকাশ থেমে আছে কারণ সংস্কারগুলো কখনোই বাস্তব আলোচনার টেবিলে আসেনি।”

কৌতূহলোদ্দীপক হলো—যখনই বিএনপি আলোচনায় যোগ দেয় এবং গঠনমূলক প্রস্তাব উপস্থাপন করে, তখনই সমীকরণ বদলে যেতে থাকে। এর ঠিক পরেই দেখা যায় গণবিক্ষোভ, ছাত্র আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক চাপের সমন্বিত প্রভাব—ফলে শেখ হাসিনার পতন দ্রুততর হয়।

আসন্ন সরকারের ওপর আগাম চাপ সৃষ্টি: অদৃশ্য সমন্বয়।
নিষ্ক্রান্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এখন একটি প্রায়–অস্বীকারযোগ্য স্বীকৃতি রয়েছে—পরবর্তী কার্যকর সরকার গঠনের সম্ভাবনা বিএনপিরই। ঠিক এই অনুমান থেকেই আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন শক্তির অদৃশ্য সমন্বয় শুরু হয়, যার লক্ষ্য ছিল আগামীর সরকারকে অস্থিতিশীল করা। যেটা এখন পর্যন্ত অব‍্যাহত রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণা নোটে উল্লেখ আছে—
 “যখন ভবিষ্যৎ ক্ষমতার কেন্দ্র স্পষ্ট হয়, প্রতিপক্ষ আগাম চাপ সৃষ্টির কর্মসূচি নেয়—এটাই দক্ষিণ এশিয়ার প্যাটার্ন।”

তড়িঘড়ি সংস্কার: উদ্দেশ্য সন্দেহজনক:
ইউনূস সরকারের মাধ্যমে সম্প্রতি যেসব সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা সময়, ধরন এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি—সবদিক থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ।

উদাহরণ: ১. নতুন নির্বাচন কমিশন কাঠামো
২. প্রশাসনিক জোন পুনর্গঠন ও ৩. ফৌজদারি প্রক্রিয়ায় আকস্মিক সংশোধন।

অধ্যাপক রাশেদুল কবীর তার গবেষণায় দেখিয়েছেন- “সংস্কার যখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে ব্যবহৃত হয়, তখন সেটি আর সংস্কার থাকে না; সেটি হয়ে দাঁড়ায় ‘Policy Weaponization’।”

বিএনপি তবুও আলোচনায় থাকে—এটাই রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচায়ক।

দ্বিমতের অধিকার কেড়ে নেওয়া: গণতন্ত্রে বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত। বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে—ভারত, যুক্তরাজ্য, কানাডা—গুরুত্বপূর্ণ নথিতে Note of Dissent বাধ্যতামূলক। এর মাধ্যমে ভিন্নমতকে নথিবদ্ধ করা হয়।

কিন্তু এখানে— ১. ডিসেন্টের সুযোগ নেই, ২. ভিন্নমত প্রদর্শনে আপত্তি ও ৩. জোরপূর্বক স্বাক্ষরের প্রচেষ্টা‌।

এগুলো আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক আচরণবিধির পরিপন্থী। এথেন্স স্কুল অফ ডেমোক্রেসির গবেষণায় উল্লেখ— “Consensus without dissent equals coerced consent.” অর্থাৎ ভিন্নমত ছাড়া ঐকমত্য জোরপূর্বক সম্মতির সমান।"

পরিকল্পিত বয়ান নির্মাণ:
সম্প্রতি প্রচার করা হচ্ছে—বিএনপি নাকি জুলাই সনদ পাশ করতে দিচ্ছে না। কিন্তু নেপথ্যে কার্যকর রয়েছে একটি Strategic Communication Unit অর্থাৎ কৌশলগত যোগাযোগ ইউনিট, যারা মিডিয়ার ন্যারেটিভ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।

বাস্তবতা হলো—
(১) বিএনপি সনদে স্বাক্ষর করেছে, (২) এনসিপির দাবিকৃত পয়েন্ট অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং (৩) সাংবিধানিক রূপান্তরে অবদান রেখেছে,

 তাহলে সমস্যা কোথায়?

লক্ষ্য: রাজপথ উত্তপ্ত করা:
একই স্ক্রিপ্ট, বারবার: ১. চাপ প্রয়োগ, ২. অসম্মান, ৩. বর্জনে উসকানি, ৪. রাস্তায় নামানো এবং ৫. তারপর প্রচারণা—“বিএনপি জনদুর্ভোগের রাজনীতি করে”

এটি নিছক textbook Political Entrapment। 
ইউনূস সরকারের প্রবণতা: নায়কত্বের আলো পুনর্গঠন

অর্থনীতিবিদ ড. নওশাদ করিম মন্তব্য করেছেন:
“ড. ইউনূস রাজনৈতিকভাবে নোবেল মুহূর্ত পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করছেন।” অর্থাৎ, নায়কের আভা ধরে রাখা এবং ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘায়িত গঠনতান্ত্রিক ত্যাগ ছাড়া সম্ভব নয়।

বিএনপি যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে—তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের নামে যেভাবে নিম্নমানের কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে—তা রাজনৈতিক ইতিহাসে কালো দাগ হয়ে থাকবে। 

আন্তর্জাতিক থিংক–ট্যাঙ্ক SouthAsiaWatch রিপোর্ট;
 “জামাত–এনসিপি জোটের উদ্দেশ্য দ্বিমুখী কৌশল:
 (১) বিকল্প পথ দিয়ে ক্ষমতায় প্রবেশ ও 
(২) বিএনপিকে আসন সমঝোতায় বাধ্য করা।”

এই উদ্দেশ্যে জেলা–উপজেলায় Political Shop Syndrome সৃষ্টি হয়েছে—রাতের বেলায় দর–কষাকষির ‘বাজার’।
বাস্তবতা—এরা এখনো অচলায়তনের স্বপ্ন বিক্রিতে ব্যস্ত।

ইতিহাসের সতর্ক ভবিষ্যদ্বাণী: 
আজ আবেগে, অন্ধ সমর্থনে গালমন্দ আসবে।
কিন্তু ইতিহাস কখনোই হঠাৎ উন্মোচিত হয় না—ধীরে, পরম্পরায়। ব্যর্থতার দিন এগুলোই সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে।

উপসংহার:

এই পুরো প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত:
(১) গণতান্ত্রিক আস্থা, (২) প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতা, (৩) ভবিষ্যৎ সরকারের কার্যকারিতা এবং (৪) রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা। 

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিবর্তন এভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে বহুবার—১৯৭৫, ১৯৯৬, ২০১৪, ২০২১—এবং ২০২৫ সেই তালিকায় যুক্ত হলো আরেকটি অধ্যায় হিসেবে।

(লেখক: সাংবাদিক কবিরুল ইসলাম কবির:)

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইতালি প্রবাসী স্ত্রীকে ভিডিও কলে রেখে নাট্যকর্মীর আত্মহত্যা

1

সংস্কার কমিশনে ২২ দফা সংস্কার প্রস্তাবনা দিলো মুক্ত গণমাধ্য

2

অতীতের রাষ্ট্রপরিচালকেরা দুর্নীতি করে আঙুল ফুলে বটগাছ হয়েছেন

3

প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন নীতিমালা পুনর্মূল্যায়নে ১৭ সদস্যের কমিট

4

আমি চুয়েটের শিক্ষার্থী, তাই আবেগ ও দায়বদ্ধতাও বেশি : চুয়েটের

5

রাণীশংকৈলে ভূয়া খারিজ দেখিয়ে জমি রেজিস্ট্রি : দলিল লেখককে জর

6

হাতীবান্ধায় ফ্রি কম্পিউটার ও ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেবে শি

7

বাড়ির দোতলায়ও পানি, ভাই–বোনের খোঁজ পাচ্ছেন না গায়িকা পুতুল

8

নির্বাচন ১৫ ফেব্রুয়ারির আগেই: জানালেন প্রেস সচিব

9

খরচ কমাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

10

আমি তোমাকে ছাড়া আর কোনো নারীকে স্পর্শ করিনি—সুইসাইড নোট লিখে

11

ঠাকুরগাঁওয়ে বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস ও জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস উদ

12

ইমাম মুহিব্বুল্লাহ অপহরণ নয়, স্বরচিত নাটক — পুলিশের চাঞ্চল্য

13

অগ্নিকাণ্ডের ৫ দিন পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশ

14

বর্তমান সরকারের প্রধান দায়িত্ব শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে বিচার

15

শাপলা কলি প্রতীকে এনসিপির সম্মতি

16

বুবলীকে ‘পিনিক’–এ যেমন দেখা যাবে

17

সাংবাদিকতা পেশায় রাজনৈতিক দলবাজি বন্ধ করা দরকার: সংস্কার কমি

18

ঠাকুরগাঁওয়ে আমন ধানের শস্য কর্তন, মাঠ দিবস ও নবান্ন উৎসব অনু

19

জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ''এনসিপির অনুপস্থিতি নিয়ে মির্জ

20