কবিরুল ইসলাম কবির:
ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। সেখানে শুয়ে আছেন ৩২ বছর বয়সী গৃহবধূ ইসরাত জাহান সাথী। শরীরের ৬০% দগ্ধ, মাংস আলগা হয়ে খসছে। চোখ ভিজে উঠেছে ব্যথায়, কণ্ঠে নেই চিৎকার। কেবল বলে—“আমি বাঁচতে চাই।”
তার পাশে নেই মা, নেই পালিত মা–বাবা, নেই স্বামীও। পাশে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আগুনের পর কুঁকড়ে যাওয়া চামড়া—আর প্রশ্নের স্তুপ।
ঘটনার পেছনে মাদক ও সহিংসতা
সাথীর স্বামী রুবেল হোসেন, পেশায় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী। মাদকের কারণে তার সংসার হারিয়ে গেছে অনেক আগে। স্থানীয়রা বলেন—“রাতেই আসে। টেবিলের ওপর কিছু গুড়া, কাগজ, ফয়েল—ঘরের বাতাস অন্যরকম।”
সাথীর একমাত্র অপরাধ—বাধা দেওয়া। অপরাধীর শেষ অস্ত্র—আগুন।
হাসপাতালের বাস্তব দৃশ্য: সহানুভূতিও চিকিৎসা:
সাথীর হাত সরু হয়ে গেছে ব্যথায়; খাবারের প্লেট ধরা তো দূরের কথা—চাল মুখে তোলার মতো শক্তিও নেই। পাশের বেডের রোগীরা বলেন—“আমরা না থাকলে মেয়ে না খেয়ে পড়ে থাকে।” এমন দৃশ্য শুধু চিকিৎসা সঙ্কটই নয়—মানবিক সঙ্কটও।
পরিবারের নীরবতা: আগুন যতটা পোড়ায়, পরিবারের নীরবতা তার চেয়েও তীক্ষ্ণ। দুই পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা জায়গা বাড়ির ভেতর। জন্মদাতা মা এসে বলেন—“মরে গেলে বাঁচি!”পালিত মা বলেন—“আমাদের কোনো মেয়ে নেই।” যে সমাজে পরিবারই বিচারক হয়ে যায়, সেখানে আগুনের শিখা যতটা পোড়ায়, পরিবারের নীরবতা তার চেয়েও তীক্ষ্ণ।
দুই শিশু—কত বয়সে শিখলো অনাথ হওয়া?
সাথীর আগের সংসারে দুই ছোট সন্তান। এক মেয়ে ও এক ছেলে—তারা হয়তো এখনো বুঝে ওঠেনি—মা আগুনে দগ্ধ, মা আজ মৃত্যুর পথযাত্রী।
আইন কোথায়?
ঘটনার ২৪ দিন পরও স্বামী মুক্ত। থানা বলছে—“অভিযোগ আসেনি।”
আইনজীবীদের মূল্যায়ন:
✅ ৩০৭ ধারায় স্পষ্ট হত্যার চেষ্ট, ✅ নারী নির্যাতন দমন আইন প্রযোজ্য, ✅ দগ্ধ মামলায় পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তদন্ত করতে আইনি ক্ষমতাসম্পন্ন।
তাহলে প্রশ্ন—অভিযোগ ছাড়া কি কেউ খুনের চেষ্টা করতে পারে?
মাদক–সহিংসতা: নীরব মহামারি
গবেষণা বলছে--
১. গৃহে সংঘটিত সহিংসতার ৬৪%–এর পেছনে মাদক, ২ অধিকাংশ নারী অভিযোগ করেন না ৩. সমাজ ‘বিবাহ’কে ঢাল বানিয়ে চলে, ফলে অপরাধীর মুখে হাসি, ভুক্তভোগীর শরীরে দগ্ধ চামড়া।
হাসপাতালের দায়—“ব্যথা থাকুক, বাজেট কম”
দগ্ধ রোগীর দিনে ৫–৬বার ড্রেসিং প্রয়োজন। সাথী পাচ্ছেন মাত্র ২টি সাধারণ ট্যাবলেট।
শরীরে ইনফেকশনের ভয়—মৃত্যুর আরেক নাম।
সামাজিক ব্যর্থতা: কে দায় নেবে?
এই ঘটনার দায় শুধু রুবেলের নয়—
✅ পরিবার ব্যর্থ, ✅ সমাজ উদাসীন, ✅ স্বাস্থ্যব্যবস্থা সঙ্কুচি, ✅ আইন–প্রশাসন নীরব।
একজন নারী যখন হাসপাতালে কাতরান, সেই দগ্ধ ঘা সমগ্র সমাজের প্রতিচ্ছবি।
সাথীর ভয় ও বেদনাময় প্রশ্ন
“আমি কি আর হাঁটবো? আমি কি আবার নিজের হাতে খেতে পারবো?” আগুন আমার স্বামী দিয়েছে, কিন্তু এর চেয়ে বড় আগুন—কেউ পাশে নেই।”
অতিরিক্ত বেদনাময় প্রশ্ন—
“আমি যদি মরে যাই—কেউ কি কাঁদবে?”
এই আগুনের মূলে যে বড় সংকটগুলো
১.মাদক—নারী নির্যাতনের প্রধান চালিকা শক্তি, ২. পরিবারের অমানবিকতা, ৩. বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ৪. গৃহে সহিংসতা ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ হিসেবে দেখা, ৫. সরকারি স্বাস্থ্য অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা।
এগুলো শুধু একটি নয়—হাজারো সাথীকে দগ্ধ করছে প্রতিদিন। ফিচারের ক্লাইম্যাক্স: আগুন শুধু দগ্ধ করে না—নিঃসঙ্গতাও জ্বালায়।
সাথীর সবচেয়ে ব্যথাময় উক্তি— “আগুন আমার স্বামী দিয়েছে, কিন্তু এর চেয়ে বড় আগুন—কেউ পাশে নেই।”
সমাজের করণীয় কী?
✅ দ্রুত গ্রেপ্তার, ✅ বিনামূল্যে উন্নত চিকিৎসা, ✅ শিশুদের সুরক্ষা, ✅ আইনি সহায়তা, ✅ কাউন্সেলিং, ✅ মাদক নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা।
কারণ—
একটি সমাজের সভ্যতা পরিমাপ হয়—নারী কতটা নিরাপদ।
শেষ কথার মতো প্রশ্ন
আজ সাথী হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।
আগুন তার শরীর পুড়িয়েছে, কিন্তু অবহেলা—সমাজের সম্পর্ক, নৈতিকতা, দায়িত্ব, সবকিছুকে ছাই করে দিচ্ছে।
আমরা কি শুধু আগুনের অভিযোগ দেখবো?
নাকি ভয়াবহ আগুনের মূল কাঠগুলোও ভাঙবো?
সাথী একজন নারী নন—তিনি একটি সংকেত,
যা বলছে—
“এই সমাজে মাদকের আগুন, অবহেলার ধোঁয়া—নারীর দগ্ধ চামড়ায় প্রমাণ হয়ে ওঠে।”
উপসংহার:------
প্রেম ও পরিবারে জটিলতার শিকার সাথী
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়নের চৌধুরীহাট বন্দিকার্ডার বাসিন্দা ইসরাত জাহান সাথীর জীবন নানা জটিলতার মুখোমুখি। জন্মের পরই বাবা মারা যাওয়ায় দুঃখজনক পরিস্থিতিতে বড় হয়েছেন। দুই বছর বয়সে মা-বেগমের অনুকম্পায় তিনি শহরের হাজীপাড়া এলাকার ইমাম উদ্দিন-বিলকিস দম্পতির কাছে দত্তক দেওয়া হন। পরবর্তীতে এই দম্পতির মেয়ের মতো পরিচয়ে বড় হন সাথী।
ঠাকুরগাঁও মহিলা কলেজে এইচএসসি অধ্যায়নরত অবস্থায় ২০১২ সালে তার পালিত মা-বাবা তাকে বিয়ে দেন। সেই সংসারে তার ৪ বছরের একটি মেয়ে ও ৯ বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে।
পরবর্তীতে সাথী ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী রুবেল হোসেনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। স্বামী ও সন্তান রেখে তিনি প্রথমে পালিয়ে যান, পরে পরিবারের বোঝানোর পর ১৫ দিন সংসার করার পর আবারও জন্মদাতা মায়ের কাছে ফিরে যান। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের শেষ দিকে পরিবারকে অবহিত না করে রুবেল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে করেন, যদিও রুবেলের ইতিমধ্যেই স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। তার অতি লোভ আর প্রেমের কারণে আজ এই অবস্থায় পতিত হয়েছে।