বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসে ৭ই নভেম্বর এক বহুমাত্রিক আলোচনার দিন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় সংকট এবং জাতীয় সংহতির অভূতপূর্ব আবেগে উজ্জীবিত এই দিনটি পরবর্তী চার দশকের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি নির্দেশ করেছে। “জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস” নামে পরিচিত ১৯৭৫ সালের এই অভ্যুত্থানকে গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার এক মোড়-ফেরানো মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করেন।
অস্থিরতার পটভূমি:
স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পরেই প্রশাসনিক দুর্বলতা, অর্থনৈতিক সংকট, কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংকুচিত করে ফেলে। পরপর সামরিক হস্তক্ষেপ, মতাদর্শিক বিভাজন এবং দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জনমনে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। সেনাবাহিনীর মধ্যেও তখন আদর্শগত ফাটল ও আস্থার সংকট প্রবল। এমন এক সময় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দূরদর্শী, স্থিতিশীল এবং ভারসাম্যপূর্ণ নেতৃত্ব ছিল সময়ের দাবি।
জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব: রাষ্ট্রীয় গতিশীলতার পরিবর্তন:
এ প্রেক্ষাপটে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) সামরিক ও রাজনৈতিক বলয়ের নতুন নেতৃত্ব হিসেবে উদ্ভাসিত হন। তাঁর নেতৃত্বের মূলে ছিল—যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা, দৃঢ় প্রশাসনিক মনোভাব এবং রাষ্ট্রগঠনের ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি সেনা বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করেন এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির দ্বার উন্মুক্ত করেন। গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ বলছে—এই স্থিতি না এলে বাংলাদেশ পরবর্তী দশকগুলোতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্ষমভাবে টিকে থাকতে পারত না।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন:
৭ই নভেম্বর-পরবর্তী সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম চালুর অনুমতি, সংবাদমাধ্যমের উন্মুক্ততা এবং মতপ্রকাশের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ গণঅংশগ্রহণের নতুন দ্বার খুলে দেয়। এর ফলেই সত্তরের দশকের শেষ ভাগে রাজনৈতিক কাঠামো পুনর্বিন্যস্ত হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়।
এই সময় জন্ম নেয় “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”—যা ভূখণ্ড, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য ও স্বাধীনতার চেতনার সমন্বিত আদর্শ। এটি নাগরিক পরিচয়কে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করে।
গ্রামীণ অর্থনীতি ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ:
জিয়াউর রহমান ছিলেন গ্রামীণ অর্থনীতির নীরব বিপ্লবী। তাঁর প্রবর্তিত সমবায় ভিত্তিক কৃষি সম্প্রসারণ, উৎপাদনমুখী সঞ্চয়, ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোগ এবং তৃণমূল প্রশাসনের ক্ষমতায়ন আজকের স্থানীয় সরকার কাঠামোর মূল ভীত। পরবর্তী গবেষণায় প্রমাণিত—এই পদক্ষেপগুলোই আধুনিক গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন দিগন্ত:
স্বাধীনতার পর বহু আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ সীমিত ছিল। জিয়াউর রহমানের সময় কূটনীতির পরিসর বিস্তৃত হয়, বৈদেশিক শ্রম বাজার উন্মুক্ত হয়, জাতিসংঘে সক্রিয় ভূমিকা ও নতুন বন্ধু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। প্রবাসী নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়—যা আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি।
সেনা-জনতার সংহতি: ঐতিহাসিক শিক্ষা:
৭ই নভেম্বরের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল সংহতি। স্বাধীনতার পর প্রথমবার সেনা ও সাধারণ জনগণের মনোভাব রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীলতার হাত থেকে রক্ষা করে। রাজনৈতিক বিজ্ঞান বলছে—রাষ্ট্রীয় সংকটে জাতীয় ঐক্যই ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশ করে। এই শিক্ষা এখনও সমান প্রাসঙ্গিক।
সমকালীন প্রেক্ষাপটে ৭ই নভেম্বরের গুরুত্ব:
আজ রাজনৈতিক বিভাজন, মতপ্রকাশের সংকোচন এবং প্রশাসনিক পক্ষপাত আবারও জাতীয় সংহতিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে। তাই ৭ই নভেম্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাষ্ট্রস্বার্থ রক্ষায় জনগণের ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ অপরিহার্য।
ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনির্মাণের নির্দেশনা:
৭ই নভেম্বরের মূল বার্তাগুলো হলো—
রাষ্ট্রীয় সংহতি, সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ, সার্বভৌম সিদ্ধান্তের অধিকার
এই মূল্যবোধগুলো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বাংলাদেশ শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।
শ্রদ্ধা:
এই ঐতিহাসিক দিবসে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। মহান আল্লাহ তাঁর রূহকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন।
লেখক: কবিরুল ইসলাম কবির,
সম্পাদক ও প্রকাশক
জাগরণ বিডি (jagoranbd.com)