
কবিরুল ইসলাম কবির:
ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। এখানে শুয়ে আছেন ৩২ বছর বয়সী গৃহবধূ ইসরাত জাহান সাথী। তার শরীরের প্রায় ৬০ শতাংশ দগ্ধ। প্রতি মুহূর্তে তার আর্তনাদ, যন্ত্রণা ও বেদনা যেন চারপাশের হাওয়া কাঁপিয়ে দেয়।
সাথী দুই বছর বয়সে জন্মদাতা মায়ের কাছে থেকে দত্তক হয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটনের মধ্যে বড় হয়েছেন। কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে বড় অভাব, শৈশব থেকেই মায়ের স্নেহ ও সান্ত্বনা। ইমাম উদ্দিন-বিলকিস বানু দম্পতির বাড়িতে বড় হওয়ার পরও মনে সবসময় একটা ফাঁকচিহ্ন রয়ে গেছে—‘আমি কোথায় belong করি?’
২০১২ সালে কলেজে পড়াশোনা চলাকালীন তার বিয়ে হয়। প্রথম সংসার থেকে জন্ম নেয় দুই সন্তান—একটি মেয়ে ও একটি ছেলে। তবে ভালোবাসা ও সংসার স্থির ছিল মাত্র কয়েক বছর। এরপর প্রেমে পড়েন ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী রুবেল হোসেনের সঙ্গে। ২০২২ সালের শেষ দিকে তারা গোপনে বিয়ে করেন, স্বামীর ও পরিবারের অজান্তে।
নতুন সংসার শুরুতে মনে হয়েছিল সব ঠিক হবে। কিন্তু বাস্তবতা একদিনই চরম রূপ ধরল। স্বামী নেশাগ্রস্ত হয়ে ওঠেন। মাদক, ঝগড়া, অর্থ সংকট ও নির্যাতন—সবই হয়ে দাঁড়ায় দৈনন্দিন জীবনের অংশ। তিনি বলেন, “আমি চুপচাপ সহ্য করতাম। ভাবতাম মানুষটা একদিন বদলে যাবে। কিন্তু সে শুধু মাদক খায়, বাড়িতে মাদক আনে। আমি দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতাম। এক মুঠো ভাতের জন্য অনেক মার খেয়েছি। হাত-পা বেঁধে পেটানো হয়েছে। তবুও আমি সংসার করতে চেয়েছি, বাঁচতে চেয়েছি।”
চলতি মাসের শুরুর দিকে স্বামী মাদক সেবন করছিলেন। বাধা দেওয়ায় রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। প্রতিবেশীরা দৌড়ে এসে তাকে উদ্ধার করেন। এরপরই শুরু হয় তার ২৪ দিন দীর্ঘ যুদ্ধ—জীবন বাঁচানোর লড়াই।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই সময়ে পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। জন্মদাতা মা, পালিত মা-বাবা বা স্বামী—কেউ দেখাশোনা করেননি। জন্মদাতা মা একদিন এসে কেবল বলেন, “আমাদের কোনো মেয়ে নেই।” পাশের বেডের নারীরা তার মুখে খাবার তুলে দেন। হাত অচল, চোখের সামনে জীবন যন্ত্রণায় ধুয়ে যাচ্ছে। তারা বলছেন, “আমরা না থাকলে সে খেতে পারবে না। ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ে।”
সাথী বলছেন, “আমি বাঁচতে চাই। নিজের হাতে খেতে চাই। আবার হাঁটতে চাই। কিন্তু ডাক্তাররা বলেছে উন্নত চিকিৎসা দরকার। সেই টাকা আমার কোথায়?”
ডা. মঞ্জুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, দগ্ধ অংশগুলোর বিশেষ পরিচর্যা এবং মানসিক সাপোর্ট দরকার। শারীরিক অবস্থা এখনও নাজুক।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ঠাকুরগাঁওয়ের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল লতিফ বলেন, “একটি মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করার পর স্বামী যদি আগুনে পুড়িয়ে দেয়, এটি শুধু ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, সামাজিক ব্যর্থতার চরম উদাহরণ। প্রশাসন, সমাজ এবং পরিবার—সবার দায়িত্ব তাকে বাঁচানো।”
জেলা প্রশাসক ইসরাত ফারজানা বলেন, ভুক্তভোগী সাথীর চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে; প্রয়োজনে ঢাকায় পাঠানো হবে।
সাথীর চোখে এখন একটাই আকুতি—বাঁচতে চাওয়া। সেই আকুতি যেন আমাদের সমাজের প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে প্রশ্ন করছে: মানুষ কি এত নিষ্ঠুর হতে পারে? আগুন আর অবহেলা দিয়ে এক নারীকে প্রানভরে হত্যা করার চেষ্টা করা হচ্ছে, অথচ আমরা চুপচাপ তাকিয়ে আছি।
ইসরাত জাহান সাথী শুধু নিজের জীবনের জন্য লড়ছেন না, তিনি প্রতিটি নির্যাতিত নারীর জন্য বেঁচে থাকার এক জীবন্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।